DAILYNEWS.ORG
আনোয়ার যখন গুলিতে আহত হন, তখন তার স্ত্রী তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। দেখতে দেখতে চলে গেল সাত মাস। আর দুই থেকে আড়াই মাস পর ভূমিষ্ঠ হবে তাদের কাঙ্ক্ষিত সন্তান। এসে দেখবে নতুন পৃথিবী। নতুন দেশ। কিন্তু এমন খুশির সময় স্ত্রী-সন্তানের পাশে থাকা হবে না আনোয়ার হোসেনের! ভূমিষ্ঠের পর কোলেও নিতে পারবেন না নিজের সন্তানকে। কারণ আনোয়ারের শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। হাঁটাচলা তো দূরের কথা, বসারও শক্তি নেই তার। এমনকি প্রস্রাব বা টয়লেটের বেগ এলে তা বলতেও পারেন না।
জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে গুলিতে আহত হন আনোয়ার। এখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন।
সম্প্রতি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আনোয়ারের মাথায় পানি দিচ্ছেন তার মা। আর তার স্ত্রী কাপড় ভিজিয়ে গা মুছে দিচ্ছেন। অন্য রোগীরা জানান- ওই ওয়ার্ডে ভর্তি গুরুতর তিনজনের মধ্যে আনোয়ারের অবস্থা বেশি খারাপ।আনোয়ার হোসেন রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার কলিমোহর গ্রামের মৃত মকবুল হোসাইনের ছেলে। থাকেন ঢাকায় গুলশানের শাহজাদপুর এলাকায়। দুই বছর আগে বিয়ে করেছেন। স্ত্রী এখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি মানিকগঞ্জ নার্সিং কলেজে বিএসসি করছেন। সেখানেই হোস্টেলে থাকতেন। কিন্তু স্বামী আহত হওয়ার পর থেকে হাসপাতালেই দিন কাটছে তার। আনোয়াররা দুই ভাই-বোন। বোন বিবাহিত। বাবা নেই, মা থাকেন গ্রামে। আহত হওয়ার পর তিনিও চলে এসেছেন ছেলের কাছে।
আনোয়ার সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটিতে বিএসসি ইন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে লেখাপড়া করেন। পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে আন্দোলনে যুক্ত হন। গত ১৯ জুলাই শাহজাদপুর কনফিডেন্স টাওয়ারের সামনে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।
ওই দিন বেলা ২টার দিকে আন্দোলন শুরু করেন। সেখানে তিন শতাধিক ছাত্র-জনতা ছিলেন। আনোয়ার জানান, পুলিশ-বিজিবি গুলি চালাচ্ছিল। মাথার ওপর ঘুরছিল হেলিকপ্টার। আবার বিভিন্ন দিকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। আমেরিকান দূতাবাসের সামনে থেকে গুলি চালাচ্ছিল পুলিশ-বিজিবি। আনোয়ার ছিলেন কনফিডেন্স টাওয়ারের সামনে। পুলিশকে লক্ষ করে ইট মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে রওনা দেন বাসার দিকে। আর ঠিক তখনই এসে গুলি লাগে তার বুকে। বেলা তখন সাড়ে ৩টা। বুকের বামপাশে গুলি ঢুকে পিঠের ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়।
গুলি লাগার পর জ্ঞান ছিল আনোয়ারের। সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা তাকে ধরে নিয়ে যান এমডেজ হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি করা হয়। সিট না থাকায় শুইয়ে রাখে ফ্লোরে। ডাক্তার আসছিলেন না। চিকিৎসা হচ্ছিল না। পরে ওই রাতেই আনোয়ারকে তার মামা-মামি আর মামাত নিয়ে যান এভারকেয়ার হাসপাতালে।এভারকেয়ারে ১৮ দিন থাকার পর ব্যয় বহন করতে না পারায় আনোয়ারকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এভারকেয়ারে চিকিৎসায় ব্যয় হয় ৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। সেখানে অপারেশন করে তার ফুসফুসে জমা পানি বের করা হয়। এভারকেয়ার থেকে আসার সময় সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ব্যায়াম করার পরামর্শ দেন। কিন্তু আনোয়ারের কোনো অনুভূতিই নেই। ব্যায়াম করবেন কীভাবে!
বাসায় ৫ দিন থাকার পর গত ১১ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি নেওয়ার জন্য ভর্তি হন। কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। এরই মধ্যে শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠে একটি ঘা হয়। ঘার চিকিৎসার জন্য গত ৫ সেপ্টেম্বর বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে রেফার করা হয়। সেই থেকেই তিনি সেখানে ভর্তি আছেন। পিঠেও অপারেশন করা হয়েছে।
আনোয়ার বলেন, ‘আমরা ভাবছি সিএমএইচএ যাব। কিন্তু ডাক্তাররা সেখানে রেফার করছেন না। গেলে ছুটি নিয়ে যেতে হবে। এভাবে আর কতদিন পড়ে থাকব! এখন ডাক্তাররা খুব একটা খোঁজখবর নিচ্ছেন না। প্রতি মাসে মা-স্ত্রী এবং আমার খাওয়াসহ সব মিলে প্রায় ৩০ হাজার খরচ হচ্ছে। দিন দিন সবকিছু সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে।
সরকারের কাছে সুস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনো চাওয়া নেই আনোয়ারের। তিনি শুধু সুস্থ হতে চান। ফিরতে চান স্বাভাবিক জীবনে।
আনোয়ারের বিষয়ে ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, স্পাইনাল কর্ডে ইনজুরি হয়েছে। যে কারণে তার শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। চলাচল করতে পারছেন না। তার পিঠের ঘা প্লাস্টিক সার্জারি করে ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু নিচের অংশ ঠিক হয়নি।
তাকে বিদেশ পাঠানোর সুপারিশ করার কথা জানিয়ে ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, এটা খুবই জটিল। সারা পৃথিবীতে এর চিকিৎসা যেমন ব্যয়বহুল। তেমনি কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। আমাদের নিউরো সার্জন যারা আছেন, তারা বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন।

Post a Comment